মহান আল্লাহ্ পাক স্বয়ং প্রিয় নবী কারিম (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর শুভ মীলাদ তথা শুভাগমনের আলোচনা করেছেন, এবং বান্দাহদের মাঝে তাঁর হাবীব (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর জিকিরকে তথা আলোচনা কে করেছেন সমুন্নত।
যেমন-
وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
অর্থাৎঃ এবং (হে মাহবুব!) আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।
[সুরা আল ইনশিরাহ্, আয়াত ৪।]
নিন্মোক্ত আয়াতে কারিমে মহান আল্লাহ্ পাক প্রিয় নবী কারিম (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর মহান মর্যাদার আলোচনা করেছেন,
অর্থাৎঃ আমি এ শহরের শপথ করছি, যেহেতু (হে মাহবূব!) আপনি এ শহরে তাশরীফ রাখছেন বা শুভাগমন করেছেন (সে কারণে), এবং আপনার পিতা এঁর শপথ এবং তাঁর বংশধরের, অর্থাৎ আপনিই (হে মাহবুব!)।
[সুরাহ্ আল বালাদ, আয়াত ১-৪।]
[বিঃদ্রঃ পিতৃ-পুরুষ দ্বারা হযরত ইব্রাহিমও হতে পারে, হযরত আবদুল মুত্তালীবও হতে পারে, হযরত আব্দুল্লাহও হতে পারে। এ বিষয়ে ইখতিলাফ রয়েছে।]
প্রত্যেক নবী (আঃ) নিজ নিজ যুগে আমাদের প্রিয়নবী ও আল্লাহর প্রিয় হাবীবের আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন।
এক. হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম তাঁর প্রিয় পুত্র ও প্রতিনিধি হযরত শীস আলায়হিস্ সালামকে নূরে মুহাম্মদীর তা’যীম করার জন্য নিন্মোক্ত ওসীয়ত করে গেছেনঃ
অর্থাৎ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম আপন পুত্র হযরত শীস আলায়হিস্ সালাম-এর উদ্দেশে বললেন, ‘‘হে আমার প্রিয় বৎস! আমার পরে তুমি আমার খলীফা। সুতরাং এ খিলাফতকে তাক্বওয়ার তাজ ও দৃঢ় ইয়াক্বীন দ্বারা আঁকড়ে ধরো। আর যখনই আল্লাহ্র নাম নেবে, তখন তাঁর সাথে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নামও উল্লেখ করবে। কারণ, আমি রূহ ও মাটির মধ্যবর্তী থাকা অবস্থায়ই তাঁর পবিত্র নাম আরশের পায়ায় (আল্লাহ্র নামের সাথে) লিখিত দেখেছি। এরপর আমি সমস্ত আসমান ভ্রমণ করেছি। আসমানগুলোতে এমন কোন স্থান ছিল না, যেখানে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম অঙ্কিত পাইনি। আমার রব আমাকে জান্নাতে বসবাস করতে দিলেন। জান্নাতের এমন কোন প্রাসাদ ও কামরা পাইনি, যেখানে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম লেখা ছিলোনা। আমি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম আরও লিখিত দেখেছি সমস্ত হুরের স্কন্ধদেশে, বেহেশ্তের সমস্ত বৃক্ষের পাতায় পাতায়, বিশেষ করে তূবা বৃক্ষের পাতায় পাতায় ও সিদ্রাতুল মোন্তাহার পাতায় পাতায়, পর্দার কিনারায়। ফেরেশতাগণের চোখের মণিতে ওই নাম অঙ্কিত দেখেছি। সুতরাং হে শীস! তুমি এ নাম বেশী পরিমাণে জপতে থাকো। কেননা, ফেরেশতাগণ পূর্ব হতেই এ নাম জপনায় মশগুল রয়েছেন।
[সূত্রঃ যারক্বানী শরীফ।]
উল্লেখ্য যে, সর্বপ্রথম দুনিয়াতে এটাই ছিলো যিকরে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম এবং হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম যখন আল্লাহর ঘর তৈরী করছিলেন, তখন হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম উক্ত ঘরের নির্মাণ কাজ কবূল করার জন্য এবং নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানদের মুসলিম হয়ে থাকার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করার পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তথা ক্বিয়াম করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর আবির্ভাব আরবে ও হযরত ইসমাঈলের বংশে হওয়ার জন্য এভাবে দোয়া করেছিলেনঃ
তরজমা: হে আমাদের রব! তুমি এ আরব ভূমিতে আমার ইসমাঈলের বংশের মধ্যে তাদের মধ্য হতেই ওই মহান রাসূলকে প্রেরণ করো, যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে ক্বোরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদেরকে পবিত্র করবেন।’’
[সূরা বাক্বারা: আয়াত ১২৯।]
এখানেও দেখা যায়- হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম রসূলুল্লাহ্ (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর আবির্ভাবের চার হাজার বছর পূর্বেই মুনাজাত আকারে তাঁর আবির্ভাব ইত্যাদির জন্য দণ্ডায়মান অবস্থায় আরয করেছেন, যা পূর্বে উল্লিখিত দু’টি আয়াতের মর্মার্থ থেকে বুঝা যায়।
ইবনে কাসীর তাঁর ‘আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া’ গ্রন্থের ২য় খণ্ড: ২৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
অর্থাৎ উক্ত দো‘আ করার সময় হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম দণ্ডায়মান অবস্থায় ছিলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এঁর এ মহান বাণীতে এ দো‘আর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে-
اَنَا دَعْوَۃُ اِبْرَاہِیْمَ
অর্থাৎ ‘‘আমি হলাম হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এঁর দো‘আ।’’
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম আল্লাহর নিকট থেকে চেয়ে আমাদের প্রিয় নবী (صلى الله عليه و آله و سلم) কে আরবে হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম-এঁর বংশে নিয়ে এসেছেন। এটা উপলব্ধির বিষয়। বর্তমানে মীলাদ শরীফে রসূলে পাকের আবির্ভাবের যে বর্ণনা আমরা দিয়ে থাকি, তা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর দো‘আর তুলনায় অতি নগণ্য। সুতরাং আমাদের মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামেরও সুন্নাত হলো।
[সূত্র. আল বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া: ২য় খণ্ড পৃ. ২৬।]
তিন. হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়ামঃ
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর আবির্ভাব সম্পর্কে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর উম্মত ও হাওয়ারীকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিজের উম্মতের কাছে তিনি আখেরী যমানার পয়গাম্বরের নাম, গুণাবলী এবং তাঁর আগমন বার্তা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
তরজমা: হে আমার প্রিয় রাসূল! আপনি স্মরণ করুন, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিলেন, হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছি। আমি আমার পূর্ববর্তী তাওরীত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং এমন এক মহান রাসূলের সুসংবাদ দিচ্ছি, যিনি আমার পরেই আগমন করবেন এবং তাঁর নাম হবে ‘আহমদ’।
[সূরা আস্সফ: আয়াত-৬]
হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এঁর ভাষণ সাধারণতঃ দণ্ডায়মান অবস্থায় হতো। আর এটা ভাষণের সাধারণ রীতিও বটে।
অর্থাৎ হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম দণ্ডায়মান (ক্বিয়ামরত) অবস্থায় তাঁর উম্মত হাওয়ারীকে আমাদের নবী করীমের আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন। সুতরাং মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর সুন্নাত হলো এবং তা নবী করীমের এ পৃথিবীতে শুভাগমনের ৫৭০ বছর পূর্বে সম্পন্ন হয়েছে। [সূত্রঃ আল-বেদায়া ও ওয়ান্ নেহায়া।]
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে আমার একটি বিশেষ মর্যাদা এ যে, আমি খতনাকৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছি এবং আমার গোপনাঙ্গ কেউই দেখেনি।
[সূত্রঃ ত্বাবরানী, যারক্বানী।]
অন্যান্য রেওয়ায়তে পাক-পবিত্র, নাভি-কর্তিত, সুরমা সজ্জিত ও বেহেশতী লেবাস পরিহিত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার বর্ণনাও এসেছে।
[সূত্রঃ মাদারিজুন্নুবূয়ত কৃত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী রহঃ।]
এছাড়াও ঐতিহাসিক হোনায়নের যুদ্ধে যখন হাওয়াযিনের প্রচূর পরিমাণে তীর নিক্ষেপের ফলে মুসলিম সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, তখনও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একা যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেনঃ
অর্থাৎ আমি আল্লাহর নবী। আমি মিথ্যাবাদী নই। আমি আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র।
প্রসঙ্গত উপরোক্ত প্রথম ঘটনাটি দাঁড়িয়ে বলা এবং বর্ণনা করা থেকে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের প্রমাণ মিলে। সুতরাং মীলাদুন্নবী ও ক্বিয়াম স্বয়ং রাসূলে পাক (صلى الله عليه و آله و سلم) এরই সুন্নাত বলে প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয় বর্ণনায়وُلِدْتُ শব্দ এসেছে। এর অর্থ হলো আমি জন্মগ্রহণ করেছি, ভূমিষ্ঠ হয়েছি, আবির্ভূত হয়েছি। এ সব বর্ণনাই ক্বিয়ামরত অবস্থায় করেছিলেন। তিনি যে নিজেই ক্বিয়াম করেছেন তাতে সন্দেহ কিসের?
সুতরাং বেলাদতের বর্ণনাকালে ক্বিয়াম করা নবী করীমেরই সুন্নাত হলো।
অর্থাৎ হযরত আবুদ্ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আবূ ‘আমের আনসারীর ঘরে গিয়ে দেখি- তিনি তাঁর সন্তানদের এবং আত্মীয়-স্বজনকে নবী করীমের জন্ম বৃত্তান্ত শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলছেন, ‘আজই সে দিন।’’ এটা দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘নি:সন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার উপর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর ফেরেশতাগণ তোমাদের সকলের জন্য মাগফিরাত কামনা করছে।’’
[সূত্রঃ র্দুরে মুনায্যাম, কৃত. আব্দুল হক এলাহাবাদী।]
অন্য বর্ণনায় আছে হুযূর-ই আক্রাম (صلى الله عليه و آله و سلم) আরো এরশাদ করেছেন,
‘‘যে তোমার এ কাজ করেছে সে তোমার মতো নাজাত (মুক্তি) পেয়েছে।’’
২. হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীস-
অর্থাৎ ‘‘একদিন তিনি (হযরত ইবনে আব্বাস) কিছু লোক নিয়ে নিজ ঘরে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর জন্ম-বৃত্তান্ত আলোচনা করে আনন্দ উৎসব করছিলেন এবং তাঁর প্রশংসাবলী আলোচনাসহ দুরূদ শরীফ পাঠ ও সালাম পেশ করছিলেন। এমন সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেখানে উপস্থিত হয়ে এটা দেখে বললেন, ‘‘তোমাদের সকলের জন্য আমার শাফা‘আত অবধারিত হয়ে গেলো।’’
অর্থাৎ ক. ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনার চেয়ে সুন্দর আমার চোখ আর কাউকে দেখেনি। আপনার চেয়ে পরিপূর্ণ কোন সন্তান মহিলারা জন্ম দেয়নি।
খ. আপনি সব দোষত্রুটি হতে মুক্ত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন। আপনার এ সূরত যেন আপনার ইচ্ছা অনুযায়ীই সৃষ্টি করা হয়েছে।
গ. আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবীর নাম আযানে নিজের নামের সাথে সংযুক্ত করেছেন। (এর প্রমাণ হলো) যখন মুআয্যিন পাঞ্জেগানা নামাযের জন্য ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ বলে আযান দেয়। আল্লাহ্ তা‘আলা আবার আপন নাম থেকে তাঁর নাম পৃথক রেখেছেন- তাঁকে অধিক মর্যাদাশীল করার লক্ষ্যে। যেমন- আরশের অধিপতির নাম হলো ‘মাহমূদ’ এবং তাঁর নাম হলো ‘মুহাম্মদ’।
[সূত্রঃ দিওয়ান-ই হাস্সান।]
লক্ষণীয় যে, উভয় নামের মূলাক্ষরগুলো হলো- ‘হামদ’ বা প্রশংসা।
দ্বিতীয়তঃ আরবীতে ‘মাহমূদ’ শব্দে রয়েছে পাঁচ হরফঃ م ح م و د আর ‘মুহাম্মদ’ শব্দেও পাঁচ হরফ; যেমন- م ح م و د
আরো লক্ষণীয় যে, হযরত হাস্সানের উক্ত ক্বাসীদায় এ কয়েকটি বিষয় প্রকাশ পায়-
১. নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর উপস্থিতিতে এ প্রশংসাসূচক ক্বসীদা পাঠ করা হয়েছে।
২. মিম্বরে দাঁড়ানো (ক্বিয়াম) অবস্থায় হুযূরে করীমের জন্ম-বৃত্তান্ত ও গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে।
৩. নবী করীমের যে কোন ধরনের ঘোষণা ত্রুটি হতে মুক্ত।
৪. হুযূর-ই আক্রামের বর্তমান সূরত শরীফ অবর্ণনীয় সুন্দর।
৫. আযানের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে আল্লাহর নামের পাশে নবী করীম (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর নাম আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংযোজিত হয়েছে।
৬. নবী করীমের ‘মুহাম্মদ’ নামের উৎস মূলও হামদ্ বা প্রশংসা।
হযরত হাস্সান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এ মীলাদ শরীফ পাঠ শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ বলে দো‘আ করতেন-
اَللّٰہُمَّ اَیِّدْہُ بِرُوْحِ الْقُدْسِ
অর্থাৎ হে আল্লাহ্! তুমি তাঁকে জিব্রাইল মারফত সাহায্য করো। ‘কানযুল ঈমান ও তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান-এ উল্লেখ করা হয়েছে- যারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর প্রশংসা করে, তাদের জন্য হযরত জিব্রাইলের গায়েবী মদদ থাকে। [সূরা মুজাদালাহ্] মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের পক্ষে এটি একটি অকাট্য ও উৎকৃষ্ট দলীল।
তিনি তাঁর ‘আন্ নি’মাতুল কুবরা আলাল আলম’-এ মীল্লাদুন্নবী পালনের ফযীলত সম্পর্কে হযরত হাসান বসরী, হযরত মা’রূফ কারখী, হযরত সারিউস্ সাক্বতী, হযরত জুনায়দ বাগদাদী, ইমাম শাফে‘ঈ, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী এবং ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিম প্রমুখ ইমাম ও সল্ফে সালেহীনের রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন।
[সূত্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭-১১।]
তাছাড়া, প্যালেস্টাইনের আল্লামা ইউসুফ নাবহানী আলায়হির রাহমাহ্-এঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘জাওয়াহিরুল বিহার: ৩য় খণ্ড’-এও মিলাদুন্নবী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশ ও ভারতে কিছু পথভ্রষ্ট লোক মীলাদুন্নবী বিষয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে লেখা পড়া না করেই মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।
পূর্ববর্তীগণের কিতাব না দেখেই তারা এ পথ অবলম্বন করছে। বিজ্ঞ পাঠকগণ নিরপেক্ষভাবে ওই দলীলগুলো মনযোগ সহকারে পাঠ করলেই আশা করি তাদের দ্বিধা দূর হয়ে যাবে।
সত্যপথ অনুসন্ধান করাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত।
সাত. মীলাদ ও ক্বিয়াম ফেরেশতাদের সুন্নাতঃ
আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর উম্মত। তাঁকে সম্মান করা ওয়াজিব। তিনি হায়াতুন্নবী। রওযা মোবারকে সশরীরেই তিনি আছেন।
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা সম্মানিত নবীগণের দেহ মুবারককে গ্রাস করা মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন।
মাটি তাঁদের দেহ মুবারক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিনষ্ট করতে পারে না। সুতরাং রওযা মুবারকে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার দেহ মুবারক নিয়েই অক্ষত অবস্থায় অবস্থান করছেন।
বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফয়যুল বারী’তে উল্লেখ করা হয়েছে-
অর্থাৎ সমস্ত আলিম এ ব্যাপারে একমত যে, সম্মানিত নবীগণ নিজ নিজ রওযা মুবারকে সশরীরে জীবিত আছেন। তাই নবীগণের হায়াত ও ওফাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং সর্বদা তাঁদের তা’যীম করা ওয়াজিব।
আট: ফেরেশতাগণের ক্বিয়ামঃ
আল্লাহ তা‘আলার ৭০ হাজার ফেরেশতা সর্বদা হুযূর-ই আন্ওয়ার (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর রওযা মুবারকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নূরের পাখা রওযা মুবারকে সামিয়ানার মত বিস্তার করে দুরূদ ও সালাম পেশ করে থাকেন। সুতরাং আমরাও ফেরেশতাদের অনুকরণে ৫/১০ মিনিট দাঁড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পেশ করলে তা বিদ‘আত হবে কেন? ফিরিশতারা কি তাহলে বিদ‘আতে লিপ্ত? মোটেই না। হাদীস শরীফ খানা নিন্মরূপ-
অর্থাৎ হযরত নুবায়হাহ্ ইবনে ওহাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাবে‘ঈ হতে বর্ণিত, একদিন হযরত কা’ব-ই আহ্বার (তাবে‘ঈ) হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর নিকট উপস্থিত হলেন। অতঃপর সাহাবা-ই কেরাম সেখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান-মানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। হযরত কা’ব বললেন, ‘‘এমন কোন দিন উদয় হয় না, যে দিন ৭০ হাজার ফেরেশতা নাযিল হয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারক বেষ্টন করে তাঁদের নূরের পাখা বিস্তার করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ ও সালাম পাঠ করেন না। অতঃপর যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে, তখন তাঁরা আসমানে আরোহণ করেন এবং তাঁদের অনুরূপ সংখ্যার (৭০ হাজার) ফেরেশতা অবতরণ করে তাঁদের মতই দুরূদ ও সালাম পাঠ করতে থাকেন। আবার ক্বিয়ামতের দিন যখন যমীন (রওযা মোবারক) বিদীর্ণ হবে, তখন তিনি ৭০ হাজার ফোরেশতা দ্বারা বেষ্টিত হয়ে প্রেমাষ্পদের রূপে আসল প্রেমিকের সাথে শীঘ্র মিলিত হবেন।’’
[সূত্রঃ দারেমী ও মিশকাত-বাবুল কারামত।]
উল্লেখিত হাদীস শরীফের নিন্মোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্যঃ
১. হযরত কা’ব-ই আহবার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মুবারকে ৭০ হাজার ফেরেশতা নাযিল হতে নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। এটি তাঁর কারামত ছিলো।
৩. রওযা মুবারকে দিনে ৭০ হাজার এবং রাতে ৭০ হাজার ফেরেশতা নাযিল হন এবং তাঁদের ডিউটি হলো- রওযা মোবারক বেষ্টন করে নূরের পাখাগুলো রওযা মোবারকের উপর সামিয়ানা স্বরূপ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পাঠ করা।
সুতরাং মুসলমানগণ ফিরিশতাদেরই অনুকরণে ক্বিয়াম সহকারে দুরূদ ও সালাম পড়ে থাকেন। [সূত্রঃ আন্ওয়ার-ই আফতাব-ই সাদাক্বাত।]
৪. হাদীসে উল্লেখিত مِثْلُهُمْ শব্দ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, সবসময় ফেরেশতাদের নিত্য নতুন দল আসে। জীবনে একবারই তাঁরা এ সুযোগ পেয়ে থাকেন।
৫. উক্ত ফেরেশতারা বিশেষ করে ক্বিয়াম সহকারে দুরূদ শরীফ পড়েন।
৬. রওযা মোবারকে পালাক্রমে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম করা হয়।
৭. মীলাদ মাহফিলে উত্তমরূপে আলোক সজ্জিত করা ও সামিয়ানা টাঙ্গানো বৈধ।
৮. নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে দাঁড়ানোর জন্যে তিনি চোখের সামনে উপস্থিত থাকা পূর্বশর্ত নয়। কেননা, ফেরেশতাদের চোখের সামনে হয়তো শুধু রওযা মোবারক পরিদৃষ্ট ছিলো।
৯. ক্বিয়ামত-দিবস পর্যন্ত ক্বিয়ামসহকারে দুরূদ ও সালামের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। দুশমনরা তা বন্ধ করতে পারবে না।
ذکر میلادالنَّبی کرتا رہونگاعمر بھر ۔جلتے رہو نجدیو جلنا تمہارا کام ہے
অর্থাৎ ‘‘আমরা মীলাদুন্নবীর মাহফিল জীবনভর করে যাবো। হে নজদীগণ! তোমরা জ্বলতে থাকো। জ্বলে মরাই তোমাদের কাজ।’’
[বাণীঃ আ’লা হযরত।]
১০. ক্বিয়ামত পর্যন্ত রওযা মুবারক অক্ষত থাকবে।
১১. রোজ হাশরে ৭০ হাজার ফেরেশতা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে পরিবেষ্টন করে ও জুলূস সহকারে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে নিয়ে যাবেন। নবী করীমের মীলাদ-ই পাক উপলক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে প্রিয় মাহবূবের সাক্ষাৎ হবে।
[সূত্রঃ লুম‘আত।]
নয়. ইজমা’ দ্বারা মীলাদুন্নবী উদযাপন প্রমাণিত।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর অনুষ্ঠান বর্তমানকার প্রচলিত নিয়মে আনুষ্ঠানিকভাবে আরম্ভ হয় ৬০৪ হিজরীতে।
হযরত ইমাম তক্বিউদ্দীন সুবকী মিশরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন ওই যুগের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও ইমাম। একদিন তাঁর দরবারে ওই যুগের বিখ্যাত ওলামা-ই কেরামের সমাবেশ ঘটেছিলো।
ইমাম তক্বিউদ্দীন রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁদের উপস্থিতিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর প্রশংসায় ইমাম সরসরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কর্তৃক রচিত দু’ লাইন কবিতা পাঠ করেন।
অর্থাৎ ‘‘সুন্দরতম কিতাবের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেও যদি নবী মোস্তফার নাম অঙ্কন করা হয়, তবুও তাঁর বিশাল মর্যাদার তুলনায় তা অতি নগণ্য। অনুরূপ, শুধু তাঁর নাম শুনেও যদি উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা সারিবদ্ধভাবে ক্বিয়াম করে (দাঁড়িয়ে যায়) অথবা আরোহী অবস্থায়ও নতজানু হয়ে যায়, তবুও তা তাঁর মহান মর্যাদার তুলনায় অতি নগণ্যই হবে।’’
সরসরীর কবিতার উক্ত চরণ দু’টি পাঠ করার সময়ে ইমাম তক্বিউদ্দীন সুবকী ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম নবী করীমের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন। মজলিসে নবী-প্রেমের ঢেউ খেলে গেলো। সকলেই ভাবের আবেগে আপ্লুত হলেন। মীলাদ শরীফে ক্বিয়ামের বৈধতার ক্ষেত্রে ইমাম তক্বিউদ্দীন সুবকী ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের উক্ত ক্বিয়ামের অনুসরণ করাই যথেষ্ট। কেননা, এ ক্বিয়াম হলো নবী করীমের পবিত্র জন্মের শুভ সংবাদ উপলক্ষে তা’যীমী ক্বিয়াম।